1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জ

ম তামিম
১৮ জুলাই ২০১৭

ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রেখেছে, সেই সঙ্গে বাড়িয়েছে বিদ্যুতের চাহিদা৷ এই চাহিদা বৃদ্ধির হার বছরে ১১ শতাংশ৷

https://p.dw.com/p/2gb80
Bangladesh Blackout
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংগতি মাথায় রেখে চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করাই মূল চ্যালেঞ্জ৷ এই চাহিদা মেটাতে ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে৷ সৌরসহ ২০১০ সালে ৫৭ ভাগ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছেন ৭৪ ভাগ মানুষ৷ এখন দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছেন৷ গেল পাঁচ বছরে মূলত রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন৷ এ যাবৎ (জুলাই, ২০১৭) বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ১৩,৫৯৬ মেগাওয়াট এবং সর্বোচ্চ উৎপাদন ৯৭৪১ মেগাওয়াট (২৭ মে, ২০১৭)৷ ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৪০৩৬ মেগাওয়াট৷ সে তুলনায় এই উৎপাদন বৃদ্ধি যে যথেষ্ট তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷

সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা

(পিএসএমপি ২০১০) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩৪,০০০ মেগাওয়াট করা হবে৷ এদেশে সবসময়ই বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা স্থাপিত ক্ষমতা এবং উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে বেশি ছিল৷ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং জ্বালানির স্বল্পতার কারণে ২০০৬-০৭ সাল থেকে কখনোই সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা যায়নি৷ ২০০৮-০৯ থেকে কাগজে-কলমে প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা বাড়লেও গ্যাস স্বল্পতার কারণে সবসময়ই প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট বন্ধ থাকে৷ সবমিলিয়ে সক্ষমতা থাকলেও এখন প্রায় ৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না৷ 

আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক আগেই জ্বালানি তেলের দাম দারুণভাবে পড়ে যায়৷ সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ বাজারে এই মূল্য কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে৷ সরকার ২০১৬ সালের এপ্রিলে লিটারপ্রতি ফার্নেস তেল ১৮ টাকা ও ডিজেল ৫ টাকা কমিয়েছে৷ ২০১৪ সালে যখন দেশের বাজারে হাইস্পিড ডিজেল (এইচএসডি) ও হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও)-এর দাম যথাক্রমে লিটারপ্রতি ৬৮ ও ৬২ টাকা ছিল তখন এসব তেল দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ত যথাক্রমে ২৬ ও ১৮ টাকা৷ অসম্ভব রকমের ভর্তুকির সুবিধা পাওয়া দেশীয় গ্যাসে (৮০ টাকা/এমএমসিএফ) বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ইউনিটপ্রতি ২ দশমিক ৫৭ টাকা৷ এখন কর মওকুফের সুবিধা নিয়ে ব্যক্তিখাত ফার্নেস তেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ৭ টাকায়৷ বিভিন্ন জ্বালানির সমন্বয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন প্রতি ইউনিটে সরকারের গড় খরচ পড়ে ৬ টাকার কিছু বেশি৷

বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাথমিক জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন জোগান এবং এ খাতের অর্থায়ন৷ সরকার বিদ্যুতের যে উৎপাদন বাড়িয়েছে তা মূলত জ্বালনি তেলভিত্তিক, যদিও এখনো দেশের ৬২ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গ্যাসনির্ভর৷ ২০০৭ সালে গ্যাসস্বল্পতার বিষয়টি সর্বপ্রথম সামনে আসে৷ তখন থেকে এ পর্যন্ত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৩০ ভাগ৷ জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার দোদুল্যমান হওয়ায় একইসঙ্গে বিরাট একটা অর্থনৈতিক ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে৷ এই ঝুঁকি সম্পর্কে সরকার ভালোভাবেই অবগত৷ তাই বড় আকারের বেসলোড সাশ্রয়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আনার চেষ্টায় নামে তারা, যদিও এক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি এখনো৷ এর একটি বড় কারণ কয়লা আমদানির সুবিধা সম্বলিত যোগাযোগ অবকাঠামো এবং বন্দরের অভাব৷ পায়রা ও মাতারবাড়ি প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনায় নিজস্ব অবকাঠামো সুবিধা থাকায় তা নিয়ে আশাবাদী সরকার৷ ২০২২ সালে এই প্রকল্পগুলো উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও এখনো সম্পূর্ণ অর্থের জোগান নিশ্চিত হয়নি এবং নির্মাণ কাজও তেমন একটা এগোয়নি৷ অন্যদিকে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকেও নানা বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে

ম তামিম
ম তামিম, অধ্যাপক, পিএমআরই বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: Privat

সরকারের জন্য আরেকটি বিকল্প হলো এলএনজি আমদানি৷ গ্যাসভিত্তিক বিশাল অবকাঠামোর সুবিধা কাজে লাগাতে সরকারের কাছে এর বিকল্প নেই৷ কিন্তু এখানেও সরকার এখন পর্যন্ত কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি৷ এর আগে ২০১০ সালে দু'বছরের মধ্যে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির ঘোষণা দেয় তারা৷ এই সময়সীমা বাড়তে বাড়তে এখন ২০১৮-১৯-এ গিয়ে ঠেকেছে৷ এই বিলম্ব সরকারকে শিল্প প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত, জ্বালানির নির্ভরযোগ্য সরবরাহ এবং এর যৌক্তিক দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে৷ ফলে গেল কয়েক বছরে যান্ত্রিক দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া শিল্প খাতে তেমন একটা অগ্রগতি দেখা যায়নি৷ এছাড়া উচ্চমূল্যের এলএনজি এলে তার দাম দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে বলে ধারণা করা যায়৷ কিন্তু এই দাম যদি পুরোটা একসঙ্গে সমন্বয় করা হয়, তাহলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে৷ কারণ, ঐতিহাসিকভাবেই দেশীয় গ্যাসের দাম সারাবিশ্বের তুলনায় এ দেশে অনেক কম৷ 

প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ ছাড়াও এ দেশের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারের একটি টেকসই পরিকল্পনা করা৷ ২০০৫ সালের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি গ্যাসনির্ভর ছিল, যা ২০০৭ সালে গ্যাস স্বল্পতার বিষয়টি সামনে এলে বাতিল হয়ে যায়৷ এমন পরিস্থিতি আগে থেকে আন্দাজ করতে না পারা গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারকদের একটি বড় ব্যর্থতা৷ এরপর ২০১০ সালে জাইকার সহযোগিতায় বর্তমান মহাপরিকল্পনাটি তৈরি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড৷ জ্বালানির বহুমুখীকরণ এবং চাহিদা ও জোগানের গ্রহণযোগ্য সমন্বয় পরিকল্পনা ছিল পিএসএমপি ২০১০-এ৷ এতে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭,৩০০ মেগাওয়াট ধরে ৩০ ভাগ বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদনের কথা বলা হয়৷ পাঁচ বছরের মধ্যে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে নতুন পিএসএমপি-২০১৫ তৈরি করা হয়, যদিও সেটি এখনো অনুমোদিত হয়নি৷ নতুন মহাপরিকল্পনায় দেখা যায়, ২০২০ সালের সর্বোচ্চ চাহিদার প্রাক্কলন ১৩,০০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা হয়েছে এবং দেশীয় কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে৷ দু'টোতেই অবশ্য জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে৷ বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ কথা বলাই যায় যে, ২০২০ সাল নাগাদ সর্বোচ্চ চাহিদা ১৩,০০০ মেগাওয়াটেই সীমাবদ্ধ থাকবে৷ তারপরও ২০২১ সালের মধ্যে ২৪,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে৷ ইতিহাস বলছে, পরিকল্পিত প্রকল্পের ৫০ ভাগ পর্যন্তই বাস্তবায়ন করতে পারে পিডিবি৷ এমনকি এই গতিতে এগুলেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির ঝুঁকি থেকে যায়৷ তাই পরিকল্পনায় সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে৷ 

পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সরকারের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন (২৪০০ মেগাওয়াট নিউক্লিয়ারে এক লাখ চার হাজার কোটি, রামপালে ১৬ হাজার কোটি, মাতারবাড়িতে ৩৬ হাজার কোটি এবং অন্যান্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের জন্য আরো ৮০ হাজার কোটি টাকা)৷ এর বাইরে সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো তৈরির খরচ তো আছেই৷ কম করে ধরলেও এর জন্য প্রায় এক লাখ বিশ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী, অনেকগুলো প্রকল্প থেকে হাজারো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলে তা সিস্টেমের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করবে৷ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তৈরির ধারণাটি পৃথিবীতে নতুন না হলেও বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে তা বাড়তি চাপ তৈরি করবে৷ সেক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে সমন্বিতত পরিকল্পনা করা দরকার৷

বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো দরকার৷ কিন্তু তাই বলে একের পর এক মেগাপ্রকল্প অনুমোদন দিলেই হবে না৷ যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ভোক্তাপ্রান্তে জ্বালানি দক্ষতা ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকৃত চাহিদার প্রাক্কলন করা দরকার৷ এর ফলে সম্পদ বাঁচবে এবং দামও সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে৷ সরকারকেও অতটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে না৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য